আয়নামহল (পর্ব-৬)

আয়নামহল (পর্ব-৬)
-সঞ্জয় গায়েন

 

২৬
মেয়েলি পুরুষের মেয়ে সাজ
সিনেমা নাটকে হাসির কাজ

জীবনে কিছু হতে হয়, কিংবা কিছু করতে হয়, এসব কখনও ভাবিনি। ভাবার দরকারই পড়ে নি। কারণটা অন্য কিছু নয়। আমি ভাবতাম কিছু করা বা কিছু হওয়া তো মানুষদের জন্য। আর আমরা তো মানুষ নই। তাই কিছু করা বা কিছু হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। যদিও আমার প্রেমিক বলত, তুমি যেই হও,কিছু না কিছু করতেই পারো। তার জন্য শুধু কিছু করার ইচ্ছে চায়। ওর কথা শুনে কবি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। লিখেওছিলাম কিছু ছাইপাঁশ। তারপর আমার প্রেমিকই একদিন সেই ছাইপাঁশে জল ঢেলে দিয়ে পালিয়েছিল।
সে যাক গে। তারপর থেকে আর কিছু হওয়ার কথা ভাবিনি। বাড়ি ছেড়ে লগনে গিয়ে লন্ড্রা নাচ নেচে বেশকিছু টাকা হাতে এসেছিল। ফিরে আসার পর, মনে হয়েছিল, কিছু করলে হয়। এমনকিছু যাতে আমিও কিছু হয়ে উঠব। কিছু হওয়ার কথা মনে হতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছিল। আর ভেসে উঠতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে মা’কে ফোন করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কথা বলতে পারি নি। বললেই মা নির্ঘাত জিজ্ঞেস করত, কি করিস এখন? তখন কি বলতাম আমি। কিছুই তো করি না। কিছু করতে পারি না আমি। মা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বলতো, তোর দাদা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তুই কি হবি?
দাদা সত্যি সত্যি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল। আমি কিচ্ছু হতে পারি নি। নিজের উপার্জন করা টাকা হাতে আসার পর কিছু হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কি হবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই অফার এসেছিল, সিনেমায় নামার। যাদের সঙ্গে লগনে গিয়েছিলাম, তারাই খবরটা এনেছিল। ততদিনে তাদের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তারাই আমার জন্য থাকার ঘর ভাড়া করে দিয়েছিল। এত সাহায্য আমার আপনজনরাও করে নি।
যাইহোক অফার পাওয়া মাত্রই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। নাই বা হতে পারলাম নায়িকা। ছোটখাটো অভিনয় করলেও অভিনেত্রী তো। কে বলতে পারে, ছোট থেকেই বড় হতেও তো পারি একদিন। অনেক আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম।
এ কি! অভিনয় তো কিছু নয়। এ যেন রাস্তায় মিছিলের মতো পর্দায় ভিড় বাড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে তালি দেওয়া। হেসে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়া।
রাজী হই নি। উল্টে প্রতিবাদ করেছিলাম। কারও শারীরিক চেহারা বা পোশাক আশাককে উদ্দেশ্যহীনভাবে সিনেমায় দেখিয়ে লোক হাসানোটা অন্যায়। অপমানকর। এসব আইন করে বন্ধ করা উচিৎ।
কিন্তু আমার প্রতিবাদ ধোপে টেকে নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সবাই। এ নাকি শিল্প। বিনোদন শিল্প। আর এভাবে দেখানো শিল্পীর স্বাধীনতা। তখন বলেছিলাম, আমাদের দেখিয়ে এতদিন তো লোককে হাসতে শিখিয়েছেন। একবার অন্যভাবে দেখিয়ে কাঁদতে শেখান। টেস্ট বদলাবার ইচ্ছে তো সবার হয়। যদি তেমন ইচ্ছে হয় খবর দেবেন, আসবো। এইসব ব’লে মুখের উপর দু’টো তালি মেরে চলে এসেছিলাম।

২৭
কি করা যায় কি হওয়া যায়
কানেতে বাজে হায় হায় হায়

শিল্পী লেখক কেউ বোঝে না। এ পৃথিবী আমাদের না। একটা ডায়েরী কিনে প্রথম পাতায় এই দু’টো লাইন লিখেছিলাম। কিন্তু যাব কোথায়? এই পৃথিবীর বাইরে কি কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। থাকলে চলে যেতাম। সত্যি সত্যি চলে যেতাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব সাত পাঁচ ভাবছিলাম। তখন আমার সেই চার লগনওয়ালি বান্ধবী হায় হায় হায় হায় করতে করতে আমার ঘরে ঢুকেছিল। সঙ্গে দুই হাতে সেই অদ্ভুত তালি যা শুনলে সকলেই চিনে যায় এরা কারা। কিন্তু ওরা অমন করে তালি বাজাতে বাজাতে আর হায় হায় করতে করতে আমার কেন ঢুকেছিল বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম।
কি লা, অমন তাকিয়ে কি দেখছিস? একজন খনখনে গলা করে জিজ্ঞেস করল। তাই শুনে আর একজন বলল, কি আর দেখবে ও ভাবছিল, কোন মওগা এল নাকি। কতদিন ধরে উপোস যাচ্ছে ডাঁসা শরীরখানা।
ওদের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এমনকি ওদের কন্ঠস্বরও অচেনা ঠেকছিল। তার মানে অমন গলা নিয়ে কেউ জন্মায় না! অমন গলার আওয়াজ, অমন তালি সব শিখতে হয়!
আমার মনের ভাবনা ওরা কেমন করে বুঝে নিত কে জানে! হঠাৎ একেবারে স্বাভাবিক হয়ে আমার পাশে বসে বলেছিল, তোর প্রতিবাদটা কাল খুব ভালো লেগেছিল। আমরাও তোর সাথে ওই কাজকে লাথ মেরে চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আসতে পারি নি। কেন জানিস? শুধু টাকা নিয়ে রেখে ছিলাম বলে। তবে হ্যাঁ, আসার সময় বলে এসেছি, এই শেষবার। আর কোন ‘হিজড়া’ হিজড়া সেজে সিনেমায় লোক হাসানোর জন্য অভিনয় করতে আসবে না। পারলে কোন অভিনেতাকে হিজড়া সাজিয়ে অভিনয় করে দেখিও। তাহলে যদি বোঝে হিজড়া সাজার জ্বালা কতখানি।
ওদের কথা শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরেছিলাম।
দূর পাগলি! কাঁদবি কেন? কাঁদলে লোকে দুর্বল ভাবে। তাই একদম কাঁদবি না। যত কষ্টই হোক, কাঁদবি না। আমাদেরও কি কষ্ট হয় না? হয়। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু সব কষ্ট তালি মেরে উড়িয়ে দিই। তুইও এখন থেকে তাই করবি। চল্‌ এবার।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, এই সমাজের বাইরে। আমাদের, শুধু আমাদের এক সমাজ আছে। সেখানে যাবি চল।
শুধু আমাদের মতো মানুষদের জন্য সমাজ! শুনেই চোখ দু’টো হেসে উঠেছিল। আর কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করেই পিছু নিয়েছিলাম।

২৯
মাস চলে যায় মাসের পর
ছুটে বেড়াই এ ঘর সে ঘর

মানুষ। মানুষ। শুধু আমাদের মতো মানুষ। দেশে আমাদের মতো মানুষ যে এত হাজার হাজার আছে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম। এত ভালো আর কখনো লাগে নি। আগে প্রতি মুহুর্তে মনে হত, এ পৃথিবী আমাদের না। কিন্তু নিজের মতো এত মানুষকে একসঙ্গে দেখার পর মনে হয়েছিল, এ পৃথিবী শুধুই আমাদের। সত্যিই এ আমাদের পৃথিবী। আমাদের দেশ। এক দেশের ভিতর এ এক অন্য দেশ। সেই দেশে আমাদের জন্য সব আছে। তার চেয়ে মজার বিষয়, এই পৃথিবীর চারপাশে আমাদের মতো মানুষেরা এমন এক পাঁচিল তুলে রেখেছে যা টপকে বাইরের পৃথিবীর কেউ ঢুকতেই পারবে না। সে কথা শুনে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এমন আবার হয় নাকি? সমাজে বাস করেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এও কি সম্ভব! আমার মুগ্ধতা, আমার আনন্দ যেমন চোখে মুখে প্রকাশ পেয়েছিল, তেমনই আমার অবিশ্বাসও লুকোতে পারি নি। দু’ একটা প্রশ্ন করতে যেতেই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। তাতে অবশ্য কোন ক্ষতি হয় নি। বরং উপকারই হয়েছিল। আমার একটা প্রশ্ন শুনে অত মানুষের ভিড় থেকে একজন বলেছিলেন, বিশ্বাস একটা অভ্যাস। আর কোন অভ্যাসই একদিনে গড়ে ওঠে না। প্রতিদিন তাকে অনুশীলন করতে হয়। তবেই একদিন তা অভ্যাসে পরিনত হয়।
কথাটার মধ্যে কী ম্যাজিক ছিল কে জানে, আমি আমাদের নিজস্ব পৃথিবীকে দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার সেই চার বন্ধুও।
সারা দেশ জুড়ে আমাদের মতো মানুষের কত ঘর। ঘুরে ঘুরে সব ঘরে যেতে লাগলাম। কী আশ্চর্য্য! যে ঘরেই গিয়েছি সকলেই নিমেষে আপন করে বুকে টেনে নিয়েছে। ক’জন অচেনা মানুষ, চেনা নেই, জানা নেই, তাদেরকে দেখেই খেতে দেওয়া, থাকতে দেওয়া সভ্য সমাজের মানুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। অথচ সেই সমাজ যাদের তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে তারা অনায়াসে পরকে আপন করে নিতে পারে। এমন করে কাছে টেনে নিতে পারে সবাই যেন আমাদের কত দিনের চেনা।
এভাবে ক’মাস ঘুরেই আমার বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল। ঠিক করে নিয়েছিলাম এরপর যে ক’দিন বাঁচব আমাদের পৃথিবীতেই বাঁচব। এই পৃথিবী আর যাই হোক, যার জন্য আমি দায়ী নই, তার জন্য আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবে না।
এতদিন আমার জন্মের জন্য বাইরের পৃথিবী অনেক প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর প্রশ্ন থামে নি। তাই আর নয়। যে পৃথিবী আমাদের ভালোবাসতে জানে না, সে পৃথিবীকে প্রশ্ন করারও সুযোগ দেব না। আর তা বন্ধ করার একমাত্র পথ আমাদের নিজস্ব পৃথিবী।

৩০
মনে কি পড়ে না মায়ের মুখ
ডুকরে কাঁদি ফেটে যায় বুক

লোকে ব’লে এ পৃথিবী নাকি গোল আর খুব ছোট। যদি কাউকে মন প্রাণ দিয়ে খোঁজা যায়, তার দেখা মিলবেই মিলবে। আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলাম। দিনের পর দিন। কই তার দেখা তো পাই নি। খুঁজতে খুঁজতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে ও যদি হারিয়ে যেত, তাহলে হয়তো ওকে ফিরে পাওয়া যেত। সংসার তো সমুদ্রের মতো। সমুদ্র যেমন সবকিছু ফিরিয়ে দেয়, আমার হারানো ছেলেকেও তেমন ফিরিয়ে দিত। হারিয়ে পাওয়ার আনন্দে ভরে যেত আমার বুক। কিন্তু ও তো হারায় নি। চলে গিয়েছিল। আর যে চলে যায়, সে বোধহয় আর ফেরে না। তবে ফেরে নি বলেই ওর কচিমুখটা বড্ড বেশি করে মনে পড়তো। সবাই বলতো, আর মনে রেখে কি হবে! এবার ভুলে যাও। মিথ্যে বলব না। ভুলতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওর মুখ যত ভোলার চেষ্টা করেছি, তত বেশি করে মনে পড়েছে। ওর মুখ যত মনে পড়ত, ততই ভাবতাম আমি মা বলে ওকে ভুলতে পারি নি। কিন্তু ও তো ছেলে। ও আর কেমন করে বুঝবে মায়ের কষ্ট। ও ঠিক মায়ের মুখটা ভুলে গিয়েছে। এমনটা মনে হলেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠতো! সত্যিই কি ওর একবারও মনে পড়ে না মায়ের কথা! ছোটবেলায় মাকে দেখতে না পেলে তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে তুলতো। আর বড় হয়ে মাকে একেবারে ভুলেই গেল! এও কি হতে পারে! এইসব ছাইপাঁশ ভাবতাম। ওর ছবিতে ভর্ত্তি অ্যালবামটাই হাত বুলোতাম। আর ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম।
ঠিক সেই সময় খোঁজ পেয়েছিলাম, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। যারা নাকি আমার ছেলের মতো ছেলেদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়। শোনামাত্রই ছুটে গিয়েছিলাম। নিজের ছেলের ছবি আঁচলে বেঁধে। গিয়ে দেখেছিলাম, সত্যি আমার ছেলের মতো অসংখ্য ছেলে। মেয়েলি ছেলে। মনের ভিতর আশার আলো উঁকি দিয়েছিল। ওরাও আশা দিয়েছিল। খুউব করে চেষ্টা করবে। ওরাই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, আমার ছবি দিয়ে। নীচে লিখে দিয়েছিল- মনে কি পড়ে না মায়ের মুখ?

৩১
কাঁধে ঢোলক হাতে তালি
বলে উঠলাম জয় মা কালী

নিজস্ব পৃথিবীতে এক এক করে সব পাচ্ছিলাম। অবশেষে একজন মাও পেয়ে গিয়েছিলাম। আমকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নিয়েছিল সেই মা। আমার গর্ভধারিনী মায়ের মুখে যে ডাক শোনার জন্য দিনের পর দিন হা পিত্যেশ করেছিলাম, সেই ডাক অবশেষে শুনতে পেয়েছিলাম। পাতানো মায়ের গলায়। আমি মেয়ে হতে পেরেছিলাম। আমার সেই পাতানো মা আমার নতুন নাম দিয়েছিল। নারী নাম। শুধু তাই নয়, আমাকে একটু একটু করে মেয়ের মতো গড়ে তুলেছিল। আমি বুক জুড়ে স্তন গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, মাঝপথে থেমেও গিয়েছিল যে স্বপ্ন, তা মা নিজে খরচ করে পূরণ করে দিয়েছিল। এককথায় একজন মা যেমন মেয়ের সুখের জন্য সব উজার করে দিতে পারে, আমার নতুন মাও তেমন সব দিচ্ছিল।
এভাবে মায়ের আদরে বেশ কাটছিল। তারপর এসেছিল সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত। মা কালীর পুজোর রাতে। মায়ের পায়ের কাছে ঢোলক রেখে তাতে ফুলের মালা পরিয়ে আরও সব নানা উপাচারে সাজিয়ে দেওয়া হল। সারারাত ধুমধাম করে পুজো হল। তারপর আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিয়ে কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছিল ঢোলক। সেই রাতে অনেক দামি দামি উপহার পেয়েছিলাম। সঙ্গে অনেক টাকাও। তবু আমার চোখে জল এসেছিল। জানি না। আনন্দে নাকি কষ্টে। কিছুতেই জলের ধারা বাগ মানছিল না। মা পিছনেই দাঁড়িয়েছিল। কি বুঝেছিল কি জানি। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, আজ থেকে আর চোখে জল নয়, সব কষ্ট দুই হাতের তালি দিয়ে বোঝাবি, বুঝলি। আর কাল, মা কালীর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তোকেও একটা জিনিস বিসর্জন দিতে হবে। যেটা তুই এতদিন ঘৃণা করে এসেছিস, যেটাতে চোখ পড়লেই তোর গা ঘিনঘিন করে উঠতো, সেটা। তোর শরীরের সব থেকে ঘৃণ্য অঙ্গ পুরুষাঙ্গটা। লিঙ্গ বিসর্জন দিয়ে তুই হিজড়া জীবন সাধনায় ব্রতী হবি। একজন সন্ন্যাসী যেমন সন্ন্যাস গ্রহণের মুহুর্তে নিজ পুরোনো জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে, এমনকি নিজ হস্তে নিজ শ্রাদ্ধাদিও সম্পন্ন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, তুইও তেমন জৈবিক লিঙ্গ ত্যাগ করে নতুন জীবনে পা রাখবি। তবেই তো তুইও সন্ন্যাসীর মতো আশীর্বাদ করার ক্ষমতা লাভ করবি। কি রে পারবি তো?
মায়ের কথার মধ্যে কী যাদু ছিল কে জানে, আমি হ্যাঁ ব’লে মাথা হেলিয়েছিলাম।

৩২
হারিয়ে ছিলাম এক মেয়ে
ধন্য জীবন অন্যদের পেয়ে

কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই ফোন করেছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন আমার সন্তানকে খুঁজে পেতে সাহায্য করার। তবে প্রত্যেকেই বলেছিলেন, ছেলে একবার যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে, তখন আর সে আগের চেহারায় নেই। এতদিনে তার নিশ্চিতভাবে নারীর শরীর হয়ে গিয়েছে। হোক, ওকে তো বাড়িতেও শাড়ি-শালোয়ারে দেখেছিলাম। তার উপর মায়ের মন। ও যে পোশাকেই থাকুক, যেমন চেহারাই হোক। মা হয়ে চিনতে পারব না, তা কি হয়। আমার মুখে এমন কথা শুনে, প্রত্যেকেই চুপ করে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা বলতে চেয়েছিল, আমার সন্তান তো আর ছেলে নেই। মেয়ে হয়ে গিয়েছে। হয়তো জীবিকা হিসেবে হিজড়াবৃত্তি বেছে নিয়েছে। আমি মা হয়ে তার তালি বাজানো, বাচ্চা নাচানোর জীবন মেনে নিতে পারবো কিনা।
সত্যিই তো, ও যতদিন আমার কাছে ছিল, ততদিন ওর মেয়ে হতে চাওয়া মেনে নিতে পারি নি। বরং দিনের পর দিন চেষ্টা করেছিলাম, ও যাতে ছেলের মতোই জীবনযাপন করে। কিন্তু ও আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম, সেই চেষ্টাটা কত ভুল ছিল। সেই ভুল বিশ্বাস নিয়েই হয়তো বাকী জীবনটা কেটে যেত। যদি না ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যাওয়ার সুযোগ হত। ওখানে যাওয়ার পরই বুঝেছিলাম, শরীরটা শুধু খোলস মাত্র। মনটাই আসল। আমরা যা কিছু করি মনের জন্য করি। মনের মতো করে করি। বোঝার পরেই মনে হয়েছিল, ছেলেটার উপর কী জুলুমটাই না করেছি। ও চেয়েছিল, মনের মতো শরীর। আর আমরা ওকে শরীরের মতো মনটাকে গড়ে নেওয়ার জন্য জোর করে গিয়েছি। যা এক কথায় অসম্ভব ছিল।
আমিও তো নারী। খুব মনে পড়ে, আমি তখন বছর আট দশেক হব। বাবা সেলুনে নিয়ে গিয়ে আমার চুল ছোট ছোট করে কাটিয়ে দিয়েছিল। ওইটুকুন বয়সে মাথা ভর্ত্তি চুল রাখতে চেয়ে পারিনি সেদিন কী কান্নায় না কেঁদেছিলাম। নারীমন মাথাভর্ত্তি চুল ভালোবাসে। কানে দুল, নাকে নাকছাবি, হাতে চুড়ি, গলায় হার পরতে ভালোবাসে। ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলপালিশ, চোখে কাজল দিতে ভালোবাসে। শাড়ি-শালোয়ার ভালোবাসে। সব বুঝেও বুঝি নি আমার ছেলেটা না ছেলে নয় মেয়েটা মন থেকেই এসব ভালোবাসতো। যদি ওর সেই ভালোবাসা বুঝে ওকে ওর মতো থাকতে দিতাম, বড় হতে দিতাম তাহলে ও হয়তো বাড়ি ছেড়ে চলে যেত না।
সেই না বোঝার মাশুল এখন দিতে হচ্ছে। তবে এই মাশুল না দিলে আমি আমার মেয়েকে চিনতে পারতাম না। আর চিনেছি বলেই ওকে আর একবার, অন্তত একবার দেখতে চাই। সেই চাওয়ার জন্যই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় বারবার আসি। ওদের সঙ্গে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যদি আমার মেয়ের দেখা পেয়ে যাই।
তবে নিজের মেয়েকে না পেলেও ওখানে গিয়ে অনেক নতুন মেয়ে পেয়েছি। আমার মেয়ের মতো মেয়ে সব। তাদের বুকে টেনে নিই। আর সুযোগ পেলেই আমার মতো অবুঝ মায়েদের ভুল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করি।
এই কাজ করতে গিয়ে আমার নতুন নাম হয়েছে। রূপান্তরকামীদের মা। এক মেয়েকে হারিয়ে এত মেয়ে পাওয়া, এতজনের মা হতে পেরে আমি ধন্য। শুধু এ জীবনে একটাই আক্ষেপ হয়তো থেকে যাবে, আমার মেয়ে আমার আগের রূপ দেখে গিয়েছে। আমার এই নতুন রূপটা দেখে গেল না।

৩৩
মা হতে চায় মায়ের মন
যোনি তো নেই প্রয়োজন

শরীর থেকে লিঙ্গত্যাগ করাকে যদি জীবনের সবথেকে বড় ত্যাগ না বলে, তবে আর কাকে ত্যাগ বলব? একজন সন্ন্যাসী গৃহত্যাগ করে যে সম্মান সমাজের কাছে পান, আমরা কেন আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে তা পায় না? সন্ন্যাসীর যেমন সাধনা আছে, আমাদেরও আছে। তবু আমাদের জন্য এ সমাজের বরাদ্দ কেবল ঘৃণার গরল। আমাদের লিঙ্গ বিসর্জন দেওয়াকে সাধনা ব’লেই মানতে চায় না। একজন মানুষ কেন লিঙ্গ বিসর্জন দেয়, তা শুধু যে এই বিসর্জন দিয়েছে, সেই বোঝে। বাকীরা যা বোঝে তা নিছকই অনুমান। আর অনুমান থেকে জন্ম নেওয়া বিশ্বাস বেশিরভাগ সময়ই ভুল হয়। ভয়ংকর হয়। ক্ষতিকর হয়। সেই ক্ষতি আমরা জীবনের পর জীবন দিয়ে পূরণ করে আসছি।
যাইহোক, লিঙ্গহীন মানুষ হওয়ার পর জীবন সম্পর্কে ধারনা অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে শুরু করেছিল। লিঙ্গ বিসর্জন দেওয়ার আগে সবাইকেই সন্দেহের চোখে দেখতাম। পরকে সহজে আপন করতে পারতাম না। শুধু মনে হত, এই বুঝি আমাকে দেখে হাসছে। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। কিন্তু লিঙ্গহীন হওয়ার পর বিশ্বাসটাই বদলে গিয়েছিল। আপনপর, ভয়ডর, সন্দেহ সব একেবারে উবে গিয়েছিল। বিপদহীন, সমস্যাহীন এক আনন্দময় জীবনের সন্ধান পেয়েছিলাম। বেশ কাটছিল। খুব তাড়াতাড়ি মায়ের প্রিয় মেয়ে হয়ে উঠেছিলাম। তারপর মা আমার বিয়ে দিল। বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গেলাম। সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। সমাজের বাইরে আমাদের যে সমাজ সেখানে এমন এক পাতানো সংসার সংসার খেলা খেলতে খেলতে, নিজেকে সত্যিই কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী মনে হত।
এরপর হঠাৎ একদিন আমিও মা হয়ে গেলাম। রেল স্টেশনে বসে ভিক্ষে করা একটি বছর আটেকের মেয়েকে নিজের মেয়ে করেছিলাম। ওর গর্ভধারিনীও স্টেশনে বসে ভিক্ষে করত। আর ভিক্ষে কম পেলেই মেয়েকে ধরে ধরে মারতো। বাধাই সেরে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই মেয়েটাকে দশ বিশ টাকা দিয়ে আসতাম। মেয়েটাও আমার ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে একথা সেকথা জিজ্ঞেস করতাম। সেই সুযোগে একদিন ও বলে ওঠে, জানো মাসি আমার ভিক্ষে করতে ভাল্লাগে না। আমার বই পড়তে ইচ্ছে করে। তুমি পড়াবে আমাকে? শুনে তখনই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। তবে ওকে বলেছিলাম, পড়াতে পারি একটা শর্তে। আর তা হল আজ থেকে মাসি নয়, আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে হবে। কি রে পারবি তো? মেয়েটি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে মা মা করে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর মা হকচকিয়ে তেড়ে এসেছিল। তবে আমি যখন বলেছিলাম, ওকে স্কুলে ভর্ত্তি করাব, অনেকদূর লেখাপড়া শেখাব… তখন শান্ত হয়ে গিয়েছিল। রাজীও হয়েছিল। কিন্তু তার বিনিময়ে ও সারাদিনে ভিক্ষে করে যতটা উপার্জন করতো তত টাকা আমাকে দিতে হবে সেকথা বলে নিয়েছিল। মা হওয়ার আনন্দে আমি তাতেও রাজী হয়ে গিয়েছিলাম।

৩৪
মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা
আয়নামহল সাক্ষী একা

মা চাইলে হয়/ না চাইলে নয়। নইলে দুই মায়ের দেখা হওয়ার তো কোন জো ছিল না। পৃথিবী যতই গোল হোক, দুই মায়ের পৃথিবী ভিন্ন ভিন্ন ছিল। তবু দেখা হয়ে গেল। একেবারে হঠাৎ করেই। কিংবা পৃথিবীর নিয়ম মেনেই।
কেউ কেউ একে যোগও বলতে পারেন।
শারদ উৎসব উপলক্ষ্যে একটি টিভি চ্যানেল মায়েদের নিয়ে এক রিয়ালিটি শো-র আয়োজন করবে বলে ঘোষণা করেছিল। তবে কোন্‌ মায়েরা, কেমন মায়েরা অংশ নিতে পারবেন কিছুই জানানো হয় নি। বিজ্ঞাপনে কেবল ট্যাগলাইন হিসাবে দেখানো হচ্ছিল-
জন্ম দিলেই নয়
জীবন দিলে হয়
কেউ মা।
বিজ্ঞাপন শেষে এও ঘোষণা ছিল অংশ নিতে হলে যোগাযোগ করুন- ৮৬×××××৬৭৩ নাম্বারে। আর শর্ত হিসাবে বলা হয়েছিল মা হয়ে ওঠার কাহিনি যা শোনাবেন তা আপনার অজান্তে যাচাই করা হবে। পুরস্কার স্বরূপ কুড়ি লক্ষ টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষণা হয়েছিল, তবে সে টাকা মা নয়, পাবে তার গর্বের সন্তান।
বিজ্ঞাপন দেখে অনেক মায়েরা যোগাযোগ করেছিল। প্রাথমিক বাছাই পর্বের শেষে শুরু হয়েছিল সেই কাঙ্খিত রিয়ালিটি শো। অংশগ্রহণকারী সব মায়েদের আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছিল। এমনকি মায়েদের সন্তান বা অন্য নিকট আত্মীয়দেরও অন্য ঘরে রেখে মায়েদের কথার যাচাই করার ব্যবস্থাও হয়েছিল। আর সব ঘরের চারদিকের দেওয়াল জুড়ে ছিল বড় বড় আরশি। ঘরের ভিতর একবার ঢূকলেই মনে হবে এ যেন আরশিনগর। যেদিকেই তাকানো হোক না কেন শুধু নিজেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। প্রতিমুহুর্তে শুধু নিজেকে দেখা। তাও একা একা। এভাবে দেখা হলেই মানুষ আরশির ওপারে থাকা নিজেকে নিজের সব কথা বলতে পারে। সহজে নিজেই নিজের মুখোমুখি হতে পারে।
সেকথা মাথায় রেখেই আয়োজকরা বোধহয় এমন ব্যবস্থা করেছিল। এবং তাদের ব্যবস্থা যে প্রত্যাশার থেকেও বেশি পরিমানে সফল হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আয়নামহলে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই অতীতযাপন করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। নিজেকেই নিজে শুনিয়েছিলাম একা একা নিজের মা হয়ে ওঠার কথা।
শেষে জেনেছিলাম রিয়ালিটি শোয়ের এটাই নাকি নিয়ম ছিল। এ শর্তও নাকি ছিল যে মা হয়ে ওঠার গল্পের শেষটুকু শোনাতে হবে সন্তানের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম হয়েছিল। কারণ অংশগ্রহণকারী হিসাবে আমি ছিলাম মা। আবার পাশের ঘরেই ছিল আমার মা।
আয়োজকরা আমাদের দুই মাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কাহিনির শেষটুকু।
মায়ের সামনে মা হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। মায়ের অবস্থাও তেমনি। মা তো ভাবতেই পারে নি, আমি মাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে মা হতে পারি। মা হয়তো ভেবেছিল, মায়ের ঘেন্না দেখে ঘর ছেড়েছিলাম আমি। তাই মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা আমার সবথেকে বেশি হবে। তারপরেও আমি মা হয়েছি। হতে চেয়েছি। আর তা দেখার পর, জানার পর মা বাকরুদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।
তাছাড়া এভাবে যে দেখা হবে, হতে পারে কেউই তো ভাবিনি। এর আগে কতবার ভেবেছি মাকে একবার দেখে আসি। দেখার জন্য এসেওছি ছুটে। কিন্তু দেখা করতে পারিনি। ভয়ে। মা যদি তাড়িয়ে দেয়…! ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয়…!
কিন্তু এ আমার কোন্‌ মা কে দেখছি! মা আমাকে হারিয়ে আমার মতো সন্তানদের মা হয়েছে! তার মানে মা আমাকে আর ঘেন্না করে না!
অবশ্য আমিও মা হওয়ার পর বুঝেছিলাম, মা আমাকে ঘেন্না করতো না। মা শুধু ভয় পেত। এই বুঝি আমার কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। সন্তানের কিছু ক্ষতি হওয়ার ভয় মা’কে আজীবন তাড়া করে বেড়ায়। সেই ভয়েই তো মা প্রতিক্ষণে সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।

মা তখনো ঠায় দাঁড়িয়েছিল। নিজে মা না হলে ভাবতাম, মা বুঝি আমাকে দেখে খুশি হয় নি। তাই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে নি। কিন্তু এখন তো আমি মা। তাই দূরে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারছিলাম, মায়ের বুক ফেটে যাচ্ছিল। তবু মা আমাকে এসে জড়িয়ে ধরছিল না তার কারণ মা ভাবছিল, আমি যদি এখন মাকে ঘৃণা ভরে সরিয়ে দিই। অপমানের তিরে বিদ্ধ করি…। মা তাই নীরবে আঁচলের আড়ালে চোখের জল লুকোচ্ছিল।
সেই চোখের জল বাঁধ ভাঙল আমি ছুটে এসে মায়ের বুকে আছড়ে পড়তেই…।
ওদিকে টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে আনানো বাউলশিল্পী প্যারোডি করে গাইতে শুরু করেছে, মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা, আমরা ভেবে করব কি…মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা…। আয়নামহল সাক্ষী একা… আমরা ভেবে করব কি… মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা…।

=সমাপ্ত=

Loading

One thought on “আয়নামহল (পর্ব-৬)

Leave A Comment